প্রয়াত হলেন শিল্পপতি Ratan Tata রতন টাটা। বয়সজনিত সমস্যা নিয়ে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। বুধবার রাতে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। রবিবার রাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর মিলেছিল যে, Ratan Tata রতন টাটাকে মুম্বইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরও দাবি করা হয়েছিল, আচমকা তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!কিন্তু সোমবার সকালেই সব জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে শিল্পপতি নিজেই জানিয়েছিলেন, সব খবর ভুয়ো। বরং বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার কারণে নিয়মমাফিক চেক-আপের জন্যই হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর বুধবার রাতে তাঁর মৃত্যুর খবর মিলল। দেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক ট্রাস্ট টাটা সন্সের অনারারি চেয়ারম্যান রতন টাটা মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন। বয়স বাড়ার কারণে, তার অনেক সমস্যা ছিল।
দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া। রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ একের পর এক সাফল্যের শিখরে ওঠে। রতন টাটা ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন এবং তখন থেকে তিনি আর পিছনে ফিরে তাকাতে পারেননি। তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে টাটা পরিষেবাদি এবং ২০০৪ সালে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসের মতো সংস্থাগুলি প্রতিষ্ঠা করেন।
নম্র আচরণের জন্য বিখ্যাত রতন টাটা বর্তমানে স্যার রতন টাটা ট্রাস্ট এবং অ্যালাইড ট্রাস্টের পাশাপাশি স্যার দোরবজি টাটা ট্রাস্ট এবং অ্যালাইড ট্রাস্ট সহ টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। ভারতের ব্যবসায়িক জগতে রতন টাটার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রয়েছে। তাকে ভারতের দুটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার পদ্ম বিভূষণ (২০০৮) এবং পদ্ম ভূষণ (২০০০) ভূষিত করা হয়েছে।
তিনি মর্যাদাপূর্ণ ক্যাথেড্রাল এবং জন কানন স্কুল, বিশপ কটন স্কুল (শিমলা), কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ডের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। রতন টাটা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। কোটিপতি হলেও তাঁর ব্যবহার ও জীবনযাত্রা ছিল মাটির কাছাকাছি। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত এমন অনেক গল্প রয়েছে, যা প্রমাণ দেয় যে প্রচারের আড়ালে হাজার হাজার লোককে সহায়তা করেছিলেন তিনি। এছাড়াও, দেশের অগ্রগতিতে রতন টাটার অবদান কখনই ভোলা যাবে না।
সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর কারখানা সরিয়ে গুজরাতের সানন্দে নিয়ে যাওয়ার সময় রতন টাটা বলেছিলেন, তিনি ‘ব্যাড এম’ (মমতা) ছেড়ে ‘গুড এম’ (মোদী)-কে বেছে নিলেন। বুধবার মধ্যরাতে তাঁর প্রয়াণের অব্যবহিত পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী— দু’জনেই শোকস্তব্ধ। মমতা তাঁর শোকবার্তায় রতন টাটাকে ‘পরোপকারী’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। প্রায় একই ভাবে মোদী রতন টাটার মধ্যে মানবতা, মমতা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকাও স্মরণ করেছেন মোদী।
শুধু মোদী বা মমতা নন, শিল্পপতি রতন টাটার মৃত্যুতে মুহ্যমান দেশ। শোক জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সকলেই এই মৃত্যুকে দেশের শিল্পক্ষেত্রের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মমতা তাঁর এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘টাটা গ্রুপের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন ভারতীয় শিল্প ক্ষেত্রের সবার আগে থাকা নেতা। একই সঙ্গে ছিলেন সাধারণ মানুষকে উৎসাহদাতা পরোপকারী।’’ আর মোদী এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘এক জন অসাধারণ মানুষ ছিলেন রতন টাটা।
তিনি ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্পগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর অবদান সংস্থার বোর্ডরুমের বাইরেও থেকেছে।’’ সমাজের উন্নতিতেও রতন টাটার অনেক অবদান ছিল বলেও উল্লেখ করেছেন মোদী। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসে সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই মতো রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে। কিন্তু, অনেকেই জমি দিতে অস্বীকার করেন। সেই অনিচ্ছুক চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে নামে সেই সময়কার বিরোধী দল তৃণমূল।
ধারাবাহিক সেই আন্দোলনের জেরে অনেক টানাপড়েনের পর টাটা গোষ্ঠী এ রাজ্য থেকে তাদের ন্যানো প্রকল্প তুলে নেয়। ৩ অক্টোবর, ২০০৮। সে দিন ছিল দুর্গাপুজোর চতুর্থী তিথি। দেবীপক্ষে ন্যানো প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন Ratan Naval Tata রতন টাটা। আর ২০২৪-এর দেবীপক্ষে ষষ্ঠীর রাতে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। মাঝখানে রয়ে গিয়েছে এক বড় অধ্যায়। ২০১১ সালে এই সিঙ্গুর আন্দোলনে ভর করেই রাজ্যের মসনদে বসার পথ প্রশস্ত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৃণমূল সরকারের প্রথম কাজই ছিল সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিতে আইন তৈরি করা।
মমতার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল এটাই। সেই বছরেই বিধানসভায় ‘সিঙ্গুর বিল’ পাশ হয়। রাজ্যপাল বিলে সই করে দেন। রাজ্য সরকার ন্যানোর জন্য বরাদ্দ জমি দখল করে। তবে ‘সিঙ্গুর আইন’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে গেল টাটা মোটর্স। সরকারি নির্দেশে স্থগিতাদেশ চাইল তারা। কলকাতা হাইকোর্ট টাটাদের আর্জি খারিজ করল। অর্ডিন্যান্সে স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাটা মোটর্স কর্তৃপক্ষ। দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে বিশ্বের সব থেকে সস্তার ছোট যাত্রী-গাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাড়া ফেলেছিল টাটারা।
সেই লগ্নি পেতে প্রতিযোগিতায় নামে বিভিন্ন রাজ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে টাটাদের চুক্তিতে তার আভাসও ছিল। উত্তরাখণ্ড বা হিমালচপ্রদেশের প্রস্তাবিত সমান আর্থিক সুবিধা (১০ বছর ধরে উৎপাদন শুল্কে ছাড়, প্রথম পাঁচ বছরে কর্পোরেট আয়করে পুরো ছাড় ও পরের পাঁচ বছরে ৩০% ছাড়) দিলে, তবে এ রাজ্যে কারখানা গড়ার আশ্বাস দিয়েছিল তারা। যা পরে রাজ্য মেনে নেয়। যদিও একাংশের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে কারখানা গড়তে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটার ব্যক্তিগত আগ্রহের কথাও শোনা যায়।
তবে শেষে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের মুখে পড়ে টাটা কারখানা সরান সানন্দে। যদিও সেখানে গিয়েও সাফল্য পায়নি ন্যানো। একটা সময়ের পরে ন্যানো তৈরি বন্ধ হয়। তবে সানন্দের কারখানায় অন্য গাড়ি তৈরি করে টাটা। পরে রাজ্যে এসে বাংলার শিল্প নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন রতন টাটা। ২০১৪ সালে কলকাতায় এসে তিনি বলেছিলেন, বিমানবন্দর থেকে পূর্ব কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে আসার পথে শিল্পায়নের কোনও চিহ্ন তাঁর চোখে পড়েনি। কারখানা বাংলা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময়ে তিনি বলেন, “বলেছিলাম মাথায় বন্দুক ঠেকালেও যাব না।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ট্রিগার টিপে দিলেন।” সেই কথা মনে করিয়ে ২০১৪ সালে কলকাতায় বণিক সভার অনুষ্ঠানে রতন টাটা বলেছিলেন, “বলেছিলাম হয় ট্রিগার টিপুন, না হয় বন্দুক সরান। আমি মাথা সরাব না। আজও একই কথা বলছি।” এ বার তিনি নিজেই সরে গেলেন চিরতরে। বাংলাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন এখনও অপূর্ণই রয়ে গেল। টিকে রইল শুধু সেই রাজনৈতিক বিতর্ক, ঠিক কাদের জন্য ন্যানো কারখানা বাংলা থেকে গুজরাতে চলে গিয়েছিল!